মুহসীনিন বইয়ের শরঈ সম্পাদকীয় ভুমিকার একাংশ
Esteem Soft Limited || 23-Oct-2021 || 178 Last Updated: 28-10-2021 04:11 AM

মুহসীনিন বইয়ের শরঈ সম্পাদকীয় ভুমিকার একাংশঃ
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে একজন আদর্শ পুরুষের কতিপয় বৈশিষ্ট্যঃ
১.যে পুরুষের মাঝে আল্লাহর ভয় আছে, আছে উত্তম চরিত্র এবং চোখ-জিহ্বার সংযম, সেই আদর্শ পুরুষ।
২. যে পুরুষ নিজ চরিত্রে বিনয় ও লজ্জার গুণের সমন্বয় করে।
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
'রহমানের বান্দা (পরম করুণাময় আল্লাহর বান্দা) তারাই যারা পৃথিবীতে বিনয়ের সঙ্গে চলা-ফেরা করে'।
[সুরা ফুরকান: ৬৩]
নবী ﷺ বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে আল্লাহ তাঁর মর্যাদা বাড়িয়ে দেন’।
[সহীহ মুসলিম : ৬৭৫৭]
ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
عَنِ ابنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنهُمَا: أنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ مَرَّ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الأنْصَار وَهُوَ يَعِظُ أخَاهُ في الحَيَاءِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: « دَعْهُ، فَإنَّ الْحَيَاءَ مِنَ الإيمَانِ ».
রাসূলুল্লাহ ﷺ এক আনসার ব্যক্তির পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। যিনি তার ভাইকে লজ্জার ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।’’
[সহীহ বুখারীঃ ২৪, ৬১১৮; সহীহ মুসলিমঃ ৩৬; সুনানে তিরমিযীঃ ২৬১৫; সুনানে নাসাঈঃ ৫০৩৩; সুনানে আবু দাউদঃ ৪৭৯৫; মুসনাদে আহমদঃ ৪৫৪০, ৫১৬১, ৬৩০৫; মুয়াত্তা মালিকঃ ১৬৭৯]
রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত,
إذا لم تستحْيِ فاصنَعْ ما شئتَ
'যখন তুমি লজ্জা করবে না, তখন যা ইচ্ছা তাই কর।' (অর্থাৎ যখন লজ্জা নাই, তখন সকল প্রকার মন্দই সমান)।
[সহীহ বুখারীঃ ৩৪৮৩; সহীহ ইবনু হিব্বানঃ ৬০৭; আত তামহীদ, ইবনু আব্দিল বার ২০/৬৮]
৩. যে পুরুষ শত ব্যস্ততা ও বিরুপ পরিস্থিতিতেও নিজ পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীর হক আদায় করে। এবং এর পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকেও যথেষ্ট সময় দিয়ে থাকেন।
৪. যে পুরুষ স্ত্রী, পরিবার এবং পরিবারের বাইরেও সচ্চরিত্র ও নীতিবান।
হযরত আবু হুরায়রা (রাদি ) সূত্রে বর্ণিত, নবীজি ﷺ বলেছেন,
أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ خُلُقًا .
‘আদর্শ মানুষ ও পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার ওই ব্যক্তি, যার চরিত্র সুন্দর এবং সে তার স্ত্রীর কাছে ভালো।’
[সুনানে তিরমিযীঃ ১১৬২, ১১৯৫; আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৩/৩৫৮; সুনানে আবী দাউদঃ ৪৬৮২; মুসনাদে আহমাদ ২/৪৭২]
নবী ﷺ উত্তম চরিত্রের বিষয়ে আল্লাহর কাছে বলতেন,
اللَّهُمَّ إنِّي أَسْأَلُكَ الهُدَى وَالتُّقَى، وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى. وفي روايةٍ : وَالْعِفَّةَ.
‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট হেদায়েত, আল্লাহর ভয়, সচ্চরিত্র ও অভাব মুক্তির প্রার্থনা করছি।’
[সহীহ মুসলিম : ২৭২১]
৫. আদর্শ পুরুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি কথা বলেনা। এতে করে তাঁর মাঝে এক ধরনের ভাব-গাম্ভীর্যতা বজায় থাকে। সাথে সাথে তারা স্পষ্টভাষীও হয়ে থাকে।
হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি ﷺ বলেন,
الْحَيَاءُ وَالْعِيُّ شُعْبَتَانِ مِنَ الْإِيمَانِ وَالْبَذَاءُ وَالْبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ
‘লজ্জা ও অল্প কথা বলা ঈমানের দুটি শাখা। আর অশ্লীলতা ও বাকপটুতা মুনাফিকের শাখা।’
[তিরমিযী: ২০২৭; আত তারগীব ওয়াত্ তারহীব: ২৬২৯; মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবাহ্: ৩০৪২৮; মুসনাদে আহমাদ: ২২৩১২; মুসতাদরাকে হাকেম: ১৭, ১৭০; শু‘আবুল ঈমান, বাইহাক্বী: ৭৭০৬; আল জামিউস সগীর: ৩২০১]
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেছেন,
لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطّعّانِ، وَلَا اللّعّانِ، وَلَا الْفَاحِشِ، وَلَا الْبَذِيءِ.
মুমিন কটুভাষী হতে পারে না, লা‘নতকারী হতে পারে না এবং অশ্লীল ও অশালীন কথা বলতে পারে না।
[আল আদাবুল মুফরাদঃ৩১২; জামে তিরমিযীঃ ১৯৭৭]
৬. আদর্শ পুরুষ অহংকারী, হিংসুক, বদ মেজাজি ও কঠোর প্রকৃতির হয়না। পাশাপাশি অতি প্রবল রাগের সময়েও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কেননা নবী করীম ﷺ বলেন,
'কাউকে আছড়ে ফেলে দেওয়ার নাম শক্তি নয় বরং (পুরুষের) আসল শক্তি হচ্ছে, প্রবল রাগের মাঝেও নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা।'
لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ .
[সহীহ মুসলিমঃ ৬৮০৯]
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেছেন,
মুমিন সবার আপন হয়, (সে অন্তরঙ্গ হয় এবং তার সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া যায়।) যে অন্তরঙ্গ হয় না এবং যার সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া যায় না, তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই।
الْمُؤْمِنُ مَأْلَفٌ، وَلَا خَيْرَ فِيمَنْ لَا يَأْلَفُ وَلَا يُؤْلَفُ.
[মুসনাদে আহমাদঃ ৯১৯৮]
৭. আদর্শ পুরুষ গাইরতমন্দ ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন হয়ে থাকে।
সা’দ ইবনে উবাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রচণ্ড আত্মর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। একবার সা’দ ইবনে উবাদা মন্তব্য করেন—“যদি কোনোদিন ঘরে এসে আমার স্ত্রীর সাথে অন্য কোনো পুরুষকে দেখি, তাহলে নিঃসন্দেহে এক কোপে তার গর্দাম ফেলে দিব।” হযরত সা’দের এই বক্তব্য নবী ﷺ শুনতে পেয়ে বলেন, “তোমরা সা’দের গাইরাত দেখে আশ্চর্য হচ্ছো? অবশ্যই আমার গাইরাত সা’দের চেয়ে বেশি। আর আল্লাহ তাআলার গাইরাত আমার চেয়েও বেশি”।
قَالَ سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ لَوْ رَأَيْتُ رَجُلاً مَعَ امْرَأَتِي لَضَرَبْتُهُ بِالسَّيْفِ غَيْرَ مُصْفَحٍ. فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ " أَتَعْجَبُونَ مِنْ غَيْرَةِ سَعْدٍ، لأَنَا أَغْيَرُ مِنْهُ، وَاللَّهُ أَغْيَرُ مِنِّي
[সহীহ বুখারীঃ ৬৮৪৬]
নবীজি ﷺ বলেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার গাইরাত আছে। আল্লাহর গাইরাত হলো- মুমিন যেন হারাম কোনো কাজে লিপ্ত না হয়”।
إِنَّ اللَّهَ يَغَارُ وَغَيْرَةُ اللَّهِ أَنْ يَأْتِيَ الْمُؤْمِنُ مَا حَرَّمَ اللَّهُ
[সহীহ বুখারীঃ ৫২২৩; সহীহ মুসলিমঃ ২৭৬২; মুসনাদে আহমাদঃ ৯০৩৮]
৮. আদর্শ পুরুষ হবে ধৈর্যশীল, শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের অধিকারী এবং মেহনতি। এছাড়াও আদর্শ মুমিন পুরুষ বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রেই শক্তিশালী হয়ে থাকে। অক্ষম এবং দুর্বল হয় না।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيّ خَيْرٌ وَأَحَبّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضّعِيفِ، وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ. اِحْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، وَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَلَا تَعْجِزْ. وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ، فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ، كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ: قَدّرَ اللهُ وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشّيْطَان.
শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে দুর্বল মুমিন অপেক্ষা প্রিয় ও উত্তম, তবে উভয়ের মাঝে কল্যাণ রয়েছে, তোমাকে যা উপকৃত করবে সে বিষয়ে তুমি অনুরাগী হও। আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। অক্ষম হয়ে যেয়ো না। কোনো কিছু যদি তোমাকে আক্রান্ত করে তুমি বলো না যে, যদি আমি এটা করতাম তাহলে তো এটা হতো (বা হতো না)। বরং বলো, আল্লাহ তকদীরে রেখেছেন। আল্লাহ যা চান তাই করেন। কেননা ‘যদি’ শব্দটা শয়তানের (বিভ্রান্ত করার) কাজের দরজা (সুযোগ) খুলে দেয়।
[সহীহ মুসলিমঃ ২৬৬৪]
৯. আদর্শ পুরুষ কখনো দুর্বলদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় না। কাউকে ধোকাও দেয়না আবার এমন এতটাই বিচক্ষণ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন হয় যে, নিজে কারো কাছ থেকে ধোকাও খায়না। কেননা মুমিন কাউকে ধোঁকা দেয় না এবং ধোঁকা খায় না’। আর ধোঁকা মুসলমানদের আদর্শ নয়।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেছেন,
لَا يُلْدَغُ الْمُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ وَاحِدٍ مَرّتَيْنِ.
মুমিন একই গর্তে দুইবার দংশিত হয় না। (মানে বারবার ধোঁকা খায় না)
[সহীহ বুখারীঃ ৬১৩৩; সহীহ মুসলিমঃ ২৯৯৮]
১০. আদর্শ মুমিন পুরুষ কপট, সংকীর্ণ মানসিকতার হতে পারে না। বরং কিছু ক্ষেত্রে সে একদমই সহজ-সরল ও উদার হবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
الْمُؤْمِنُ غِرّ كَرِيمٌ، وَالْفَاجِرُ خَبّ لَئِيمٌ.
মুমিন সহজ-সরল, উদার হয়ে থাকে। আর ফাজের (পাপিষ্ঠ) হয়ে থাকে ঠকবাজ, সংকীর্ণমনা।
[আল আদাবুল মুফরাদঃ ৪১৮; সুনানে আবী দাউদঃ ৪৭৫৭; জামে তিরমিযীঃ ১৯৬৪; মুসনাদে আহমাদঃ ২/৩৯৪ হাঃ ৯১১৮- হাদীসের সনদ হাসান]