স্থূলতা বা মেদভুরি- অসুখ বা ডিজিজ।
Esteem Soft Limited || 23-Oct-2021 || 143 Last Updated: 28-10-2021 08:43 AM

স্থূলতা বা মেদভুরি- অসুখ বা ডিজিজ।
মানব সভ্যতা আজ বিকশিত হয়েছে । এর মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যের পরিচর্যা জন্য শিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞান অর্জনের দুরন্ত আগ্রহ ও নিরন্তর প্রচেষ্টা। মানুষের এই স্বাস্থ্য ক্রমাগত নানারকম নতুন নতুন রোগবালাই মোকাবেলা করে চলছে। এই সমস্ত রোগ বালাই যত না বাহ্যিক তার চেয়েও বেশি আভ্যন্তরীণ বা মানুষেরই নিজের সৃষ্টি। মানুষের এই রোগ বালাই কি বিজ্ঞানীগণ মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন প্রথমত সংক্রামক রোগ দ্বিতীয়তঃ অসংক্রামক রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে দেখা যায় বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ ব্যাপকভাবে অপরিণত বয়সে মারা যেত কিন্তু এখন বিশ্বব্যাপী গড় মৃত্যুর হার ক্রমাগতভাবে সংক্রামক ব্যাধি থেকে অসংক্রামক ব্যাধিতে ধাবিত হচ্ছে। যেহেতু জনসাধারণের জন্য বা সর্বসাধারণের জন্য এটি একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা সেহেতু বৈজ্ঞানিক কিছু বিষয় এখানে আমি উল্লেখ করেছি তবে পেশাজীবীদের মত করে আমি কোন কিছু এখানে উল্লেখ করছি না।
মোটাদাগে অসংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি একদিনে না হয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ তিলে তিলে গড়ে ওঠে এবং রোগ হিসেবে যেমন উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিস ক্যান্সার স্ট্রোক কিডনির অসুখ, অন্ধত্ব হাত পা হারানো ইত্যাদি হঠাৎ একদিন দৃশ্যমান হয় বা প্রকাশ পায়।অসংক্রামক ব্যাধির পরিনীতি হয় মৃত্যু অথবা ভগ্ন বা রুগ্ন শরীর নিয়ে কোন রকম বেঁচে থাকা যা জীবনের কোন অর্থ বহন করে না। অসংক্রামক রোগের শুরুর প্রথম স্তর হল এক বা একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন উপাদানের সন্নিবেশন। দ্বিতীয় স্তর হল ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। তৃতীয় স্তর হলো মেটাবলিক সিনড্রোম। চতুর্থ স্তর হল- সুনির্দিষ্ট রোগের আবির্ভাব যথা পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক, হূদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির অকার্যকারিতা, লিভারের বিভিন্ন ধরনের অসুখ, ক্যান্সার, অঙ্গহানি, অন্ধত্ব, বিভিন্ন মানসিক রোগ ইত্যাদি।
মেটাবলিক সিনড্রোম সর্বপ্রথম WHO জনসম্মুক্ষে ১৯৯৮ সালে প্রকাশ করে সেখানে মূল উপাদান স্থূলতা বিশেষ করে মেদ ভুড়ি যা একটি বৈষয়িক স্বাস্থ্য সমস্যা ও মহামারী। মেদভুঁড়ি কে কেন্দ্র করে আই ডি এফ বা WHO মেটাবলিক সিনড্রোমকে সংজ্ঞায়িত করে। আবার স্থূলতা বা ওবেসিটি কে নির্ণয়ের জন্য বি এম আই নামক একটি টুলস ব্যবহার করা হয়। Asia-Pacific Region WHO এর মতে এশিয়ানদের বিএমআই ২৫ বা তদূর্ধ্ব হলে স্থূল বলে অথবা যাদের বিএমআই ২৩ বা তদূর্ধ্ব তাদের মাত্রারিক্ত ওজন বা ওজনাধিক্য বলে। সহজ ভাষায় শরীরের অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত চর্বির উপস্থিতিকে স্থূলতা বলে। এক সময় স্থূলতাকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হতো মানে যার ভুঁড়ি যত সে তত অভিজাত, কিন্তু অধুনা সত্তর-আশির দশক থেকে বিজ্ঞানীমহলে স্থূলতাকে রোগ সৃষ্টিকারী একটি ঝুঁকি হিসাবে দেখা শুরু করেন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে WHO মেটাবলিক সিনড্রোম নামক অসুখ এর মধ্যে একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে সন্নিবেশিত করেন এবং ২০১২ সালে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্লিনিক্যাল এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট একটি প্রবন্ধে স্থূলতাকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করে এবং তার পরের বছর জুন ২০১৩ সালে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন স্থূলতাকে ক্রনিক ডিজিজ হিসেবে ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে তারা বলে যে রোগ হিসেবে কোন অবস্থাকে ঘোষণা করতে হলে যা যা শর্ত পূরণ করা দরকার ওবেসিটি তার সবটাই পূরণ করে। এখন প্রশ্ন হলো স্থূলতা কি কারনে হয়? সহজ উত্তর এটাই যে - শক্তি গ্রহণ ও খরচের মধ্যে ভারসাম্য হীনতা। এই ভারসাম্যহীনতা তখনই তৈরি হয় যখন মানুষ নিজেই নিজের শরীর সম্বন্ধে একদম উদাসীন থাকে।
এই স্থূলতা দুই ধরনের ১. শুধুমাত্র পেটের মধ্যেই চর্বি জমা বা মেদ ভুঁড বা আপল সেপ ওবেসিটি বলে। ২. চর্বি সমস্ত শরীর সমসত্ব ভাবে বিন্যস্ত যাকে পিয়ার সেপ ওবেসিটি বলে। এই দুটির মধ্য মেদ ভুঁড়ির স্থূলতা এশিয়ান জনসাধারণের মধ্যে সবচাইতে বেশি এবং কার্ডিও মেটাবোলিক ডিজিজও সবচেয়ে বেশি তৈরি করে। এখানে উল্লেখ্য যে প্রথম স্তর থেকে চতুর্থ স্তরের অর্থাৎ রোগ প্রকাশ পেতে যেমন ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে কয়েক মাস থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত লেগে যায় অন্যান্য ক্ষেত্রেও এইরকম রোগীর অবস্থা থাকে। রোগীর এই সুপ্ত কালীন অবস্থায় যদি আমরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হই তাহলে তিনি বিভিন্ন ঝুঁকি নিরূপণ, শারীরিক পরীক্ষা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কিছু ল্যাবরেটরী পরীক্ষার মাধ্যমে কার্ডিও মেটাবলিক স্ট্যাটাস নির্ধারণ করে আপনাকে যথোপযুক্ত চিকিৎসা ও পরিকল্পনা দিবেন। গবেষণা গবেষকরা বলেন ৪০ বছর বয়স্ক অধূমপায়ী কোন স্থূলকায় ব্যক্তির গড়ে ৭ (সাত) বৎসর কম বাঁচে আর ধূমপায়ী ব্যক্তি গড়ে ১৩ বৎসর কম বাঁচে। স্থূল ব্যক্তির শরীরের অভ্যন্তরে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রকার বিপাক প্রক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলতে থাকে ও অদুর ভবিষ্যতের যেকোনো সময় কার্ডিওমেটাবলিক ডিজিজ যথা ডায়াবেটিস, রক্তের চর্বির অস্বাভাবিকতা বা ডিসলিপিডেমিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ ইত্যাদি তৈরি করে। এছাড়াও আরো বিভিন্ন রোগ যেমন, মাথাব্যথা বা মস্তিষ্কের উচ্চচাপ, ইটিং ডিজঅর্ডার, বিষন্নতা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, গলস্টোন ডিজিজ বা কিডনির পাথর বুক জ্বালাপোড়া লিভারে চর্বি জমা অন্ত্রের ক্যান্সার, কোমরে পিঠে, ঘাড়ে হাটুতে উপায় পায়ের গিটে ব্যথা বা অস্টিও আর্থ্রাইটিস, অপরিণত বয়সে যৌবন প্রাপ্তি, মাসিকের বিভিন্ন অনিয়ম , সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, নাক ডাকা বা স্লিপ অ্যাপনিয়া, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি, পা ফোলা, ভেরিকোস ভেইন, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ, হার্নিয়া ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যান্সার তৈরি করতে পারে।
কেন হয়- প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ বা শক্তি গ্রহণ যেমন একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে খাওয়া, ঘনঘন নাস্তা করা, অনিয়মিত খাবার খাওয়া, প্রচুর পরিমাণে শক্তি ঘন খাবার গ্রহণ, খাদ্যচক্রের মধ্যে উপবাস অংশটুকু বাতিল করা।
আরেকটি হলো শক্তি খরচ বা ব্যবহার না করা যেমন শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন যথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতে, হাঁট বাজারে, মসজিদ-উপাসনালয়ে, স্বল্প দুরত্বের ভ্রমনে হেঁটে না যাওয়া, গৃহস্থালির কাজ নিজে হাতে না করা, নিয়মিত শারীরিক খেলাধূলা না করা, দীর্ঘ সময় মোবাইল ল্যাপটপ কম্পিউটার বা টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা, টেবিল জব বা ডেস্ক জব করা, দৈনন্দিন কাজে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির অতিব্যবহার করা বা লোকজন নিয়োগ দেওয়া। একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেই দেখবেন স্থূলতার প্রধান কারণই হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অনিয়ম এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও খাবার গ্রহন, স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভাব।
প্রতিকার বা চিকিৎসা- প্রাইমারি প্রিভেনশন বা প্রতিরোধেই হচ্ছে সেরা দাওয়াই । বলা হয় প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই সর্বোত্তম সেই হিসাবে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ যা স্থূলতা তৈরি করে সেইগুলি এখনই চিহ্নিত করতে হবে এবং সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। গবেষকরা প্রমান করেছেন যে স্থূলতা বা ওজনাধিক্য কমালে যেভাবে হোক না কেন কয়েকটি উপকার পাওয়া যায় যেমন ইনসুলিন সেন্সিভিটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়, লিভারের চর্বি কমায় কমে যায় , ডায়াবেটিস হওয়ার প্রক্রিয়া ধীরগতি হয় এমনকি শতভাগ প্রতিরোধ করা যায়, উচ্চ রক্তচাপ ও ডিসলিপিডেমিয়ার যথেষ্ট উন্নতি হয়, বিভিন্ন প্রকার প্রদাহ মার্কার গুলি কমে যায় অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে কার্ডিওমেটাবলিক ডিজিজের ভয়ংকর অগ্রযাত্রা থমকে যায়।
আসলে রোগের প্রথম তিন অবস্থা পর্যন্ত রোগ নির্ণীত হলে কোন অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন ঔষধ লাগেনা শুধুমাত্র মৌলিক কয়েকটি ক্ষেত্রে সংশোধন আনলেই এই রোগ থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব।
বিষয় গুলি হল (ক) জীবন ধারার আমূল পরিবর্তন- প্রথমেই আপনার কার্যসূচী বা নিয়ত ঠিক করুন যেমন ১. নিজেকে চিনুন অর্থাৎ আপনি যে মোটা সে সত্য নিজেকে নিজের কাছে মেনে নিন ২. নিজের কাছে অঙ্গীকার করুন আপনি ওজন কমাতেও বদ্ধপরিকর ৩. একজন বন্ধু বা আত্মীয় বা কোন শুভানুধ্যায়ীকে সনাক্ত করুন যিনি আপনাকে প্রতিদিন আপনার উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে সহায়তা করতে ইচ্ছুক হবেন ৪. তৈরি হন এবং একটা দিন তারিখ ধার্য করুন যখন আপনার পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা কার্যকর করতে সাব্যস্ত আছেন আপনার মত স্টেপ নিতে শুরু করুন ৫. যখন আপনার প্ল্যান কার্যকরী বলে প্রমাণিত হচ্ছে তখন নিজেকে একটু পুরস্কৃত করুন ৬. উপযুক্ত ফল লাভ না হলে আগের লক্ষ একটু কমিয়ে আনুন ৭. উদ্দেশ্য সাধনের ব্যাপারে কোন অন্তরায় দেখা দিলে তা পুনরায় চেষ্টা করুন।
(খ) ডায়েটিং প্ল্যান আপনার চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদ এর নিকট থেকে নিয়ে নিন এবং তদনুযায়ী বাস্তবায়ন করুন
(গ) রাত্রির প্রথম ভাগেই ধুম শুরু করে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা নিরবছিন্ন আরামদায়ক একটি ধুম দিন যাতে পরের দিন নিজেকে সতেজ অনুভব করতে
পারেন
(ঘ) সবসময় মানসিকভাবে নিজেকে প্রফুল্ল ও চাংগা রাখুন
(ঙ) নিয়মিত রোজা বা উপবাস পালন করুন
(চ) ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী শরীরচর্চা, হাঁটা ও ব্যায়ামের করুন
(ছ) শারীরিকভাবে সক্রিয় জীবনযাপন করুন এবং নিষ্ক্রিয় জীবনযাপনকে ঘৃণা করুন প্রয়োজনে অন্যজনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করুন।
(জ) খাদ্য ও পুষ্টি সম্বন্ধে কোন একটি রেফারেন্স বুক, সাইট, পেপার-পত্রিকা অনুসরণ করুন ও জ্ঞান অর্জন করুন
(ঝ) সমস্ত প্রকার মাদক ও ধূমপানকে না বলুন
(ঞ) আপনার পছন্দের চিকিৎসকের নিকট নিয়মিত শরণাপন্ন হন এবং আপনার অধীত জ্ঞান তার কাছ থেকে যাচাই করে নিন।
টেক্সট হোম মেসেজ- স্থূলতা একটি রোগ ও অসংখ্য অসংক্রামক রোগ এর আঁতুড়ঘর যা শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য।
ডা: জয়নাল আবেদীন জুয়েল
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), সিডিসি (বারডেম), এমডি (কার্ডিওলজি) B.S.M.M.U; ঢাকা
সদস্য - ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ কার্ডিওলজি (M-ESC)
কনসালটেন্ট কার্ডিওলজি
কার্ডিওলজি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ